আফগানিস্তানে কী কী বই নিষিদ্ধ হলো, তালেবান কী বার্তা দিচ্ছে

আফগানিস্তানে তালেবান শাসনামলে শিক্ষা ও সংস্কৃতি ক্ষেত্রে নতুন এক ধারা তৈরি হচ্ছে। ইসলামি শরিয়াহ ও আফগান মূল্যবোধের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ শিক্ষাব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে কর্তৃপক্ষ ব্যাপক পদক্ষেপ নিয়েছে। এর অংশ হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়, গ্রন্থাগার ও বইয়ের দোকান থেকে শত শত বই এবং পাঠ্যক্রম নিষিদ্ধ করা হচ্ছে। এসব নিষিদ্ধ বইয়ের মধ্যে শুধু পশ্চিমা লেখকদের সাহিত্য নয়, রয়েছে প্রভাবশালী ইসলামি চিন্তাবিদ, আফগান লেখক ও ইরানি প্রকাশকের গ্রন্থও।

নিষেধাজ্ঞার সূচনা

২০২১ সালের আগস্টে তালেবান ক্ষমতায় ফেরার পর থেকেই শিক্ষা ও সংস্কৃতির ওপর নিয়ন্ত্রণ শুরু করে। ২০২৪ সালে কাবুলের গ্রন্থাগারে ৪০০ বই নিষিদ্ধের তালিকা প্রকাশ করা হয়। এসব বইয়ের মধ্যে গণতন্ত্র, নারী অধিকার, শিয়া মতবাদ এবং প্রতিরোধ নেতা আহমদ শাহ মাসুদের জীবনী অন্তর্ভুক্ত ছিল। পরে ২০২৫ সালের জুলাইয়ে ধর্মীয় নির্দেশনা, হজ ও ধর্মবিষয়ক, তথ্য ও সংস্কৃতি এবং উচ্চশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের যৌথ বৈঠকে দেশব্যাপী বই নিয়ন্ত্রণ পরিকল্পনা অনুমোদন হয়। তালেবানের সর্বোচ্চ নেতা মোল্লা হিবাতুল্লাহ আখুন্দজাদার নির্দেশে গঠিত ১৪ সদস্যের কমিটি এ কাজের দায়িত্বে রয়েছে।

ধর্মবিষয়ক মন্ত্রী নূর মোহাম্মদ সাকিব জানান, “আমাদের উদ্দেশ্য ইসলাম ও আফগান মূল্যবোধবিরোধী বই সরিয়ে দিয়ে বিশুদ্ধ ইসলামি বিষয়বস্তু প্রচার করা।”

নিষিদ্ধ পাঠ্যবিষয়

তালেবান উচ্চশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উপমন্ত্রী জিয়াউর রহমান আরিওবি ১৮টি পাঠ্যবিষয়ে নিষেধাজ্ঞা জারি করেন। এর মধ্যে রয়েছে—ইসলামি রাজনৈতিক আন্দোলন, সাংবিধানিক আইন, ধর্মের ইতিহাস, সুশাসন, নারী সমাজবিজ্ঞান, মানবাধিকার, গণতন্ত্র, বিশ্বায়ন ও উন্নয়ন, নৈতিক দর্শন, নির্বাচনব্যবস্থা এবং নারী-পুরুষ সমতা সম্পর্কিত কোর্স। আগে এসব বিষয় বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন, রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও সমাজবিজ্ঞান অনুষদে বাধ্যতামূলক ছিল। তালেবানের মতে, এগুলো শরিয়াহর সঙ্গে সাংঘর্ষিক।

প্রভাবশালী ইসলামি চিন্তাবিদদের বইও নিষিদ্ধ

নিষিদ্ধের তালিকায় সালাফি মতাদর্শের প্রতিষ্ঠাতা মুহাম্মদ ইবনে আবদুল ওয়াহহাবের কিতাব আত-তাওহিদ, মাওলানা আবুল আলা মওদুদীর কোরআন কি চার বনিয়াদি ইসতিলাহি, সাইয়েদ কুতুবের সোশ্যাল জাস্টিস ইন ইসলাম, জামালউদ্দীন আফগানির রচনা ও জীবনী, ইউসুফ আল-কারযাভির আল-হালাল ওয়াল-হারাম ফিল ইসলাম অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। এমনকি আফগান শিক্ষাবিদ শামসুস সাদাত জাহেদি, আবদুর রহমান সেলিম ও সাবেক উপবিচারমন্ত্রী জাকিয়া আদেলির লেখা বইও নিষিদ্ধ হয়েছে।

পশ্চিমা লেখকদের রচনা

তালেবান জনপ্রিয় পশ্চিমা লেখকদের অনেক বইও তালিকাভুক্ত করেছে। এর মধ্যে রয়েছে ইউভাল নোয়া হারারির স্যাপিয়েন্স, দান্তের দ্য ডিভাইন কমেডি, কাহলিল জিবরানের দ্য প্রফেট, জন আর্ট শোল্টের গ্লোবালাইজেশন: আ ক্রিটিকাল ইন্ট্রোডাকশন, ব্রুস জে কোহেনের ইন্ট্রোডাকশন টু সোশিওলজি ও জর্জ রিৎজারের কনটেম্পোরারি সোশিওলজিক্যাল থিওরি

ইরানি লেখক ও সম্পর্কের টানাপোড়েন

ইনডিপেনডেন্ট পার্সিয়ানের তথ্যমতে, প্রায় ৩১০টি ইরানি লেখকের বই নিষিদ্ধ হয়েছে। এর পেছনে শিয়া মতাদর্শের প্রভাব ও আফগানিস্তান-ইরান সম্পর্কের টানাপোড়েন বড় কারণ। বিশেষ করে পানির অধিকার ও শরণার্থী বহিষ্কার ইস্যু এ উত্তেজনা বাড়িয়েছে।

শিক্ষা ও প্রকাশনায় প্রভাব

শিক্ষা বিশেষজ্ঞদের মতে, এসব নিষেধাজ্ঞা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠদান ব্যাহত করছে। বিকল্প পাঠ্যবই দ্রুত প্রস্তুত না হওয়ায় শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা সমস্যায় পড়ছেন। অন্যদিকে প্রকাশনা শিল্পও সংকটে পড়েছে। কাবুলের প্রকাশকদের অভিযোগ, ইরান থেকে আমদানি করা বই সীমান্তে আটকে দেওয়া হয়। এতে বাজারে বইয়ের সংকট তৈরি হচ্ছে।

Share With Your Friends

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *