দ্বিতীয় মেয়াদে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হিসেবে ক্ষমতায় আসার পর রাশিয়া নিয়ে ডোনাল্ড ট্রাম্পের অবস্থান অনেককে অবাক করেছিল। ইউক্রেন–রাশিয়া যুদ্ধের বিষয়ে জাতিসংঘে একাধিকবার রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনকে সমর্থন করেছিলেন তিনি। এমনকি গত ফেব্রুয়ারিতে হোয়াইট হাউসে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির সঙ্গে সাক্ষাতে ট্রাম্প সরাসরি অভিযোগ করেন—জেলেনস্কি শান্তি চান না, আর যদি সমঝোতায় রাজি না হন, তবে যুক্তরাষ্ট্র এ বিষয়ে আর থাকবে না।
এই প্রেক্ষাপটে অনেক বিশেষজ্ঞই ভেবেছিলেন, ভারত–রাশিয়ার বন্ধুত্ব নিয়ে ট্রাম্পের তেমন আপত্তি থাকবে না। কিন্তু গত পাঁচ মাসে চিত্র পাল্টে গেছে দ্রুত। বিশেষ করে জ্বালানি ও প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে ভারত–রাশিয়ার অংশীদারত্বকে ভালো চোখে দেখছেন না ট্রাম্প। এর জের ধরেই ভারতের ওপর দ্বিগুণ বাণিজ্য শুল্ক আরোপের ঘোষণা দিয়েছেন তিনি—যা এখন মোট ৫০ শতাংশে দাঁড়িয়েছে।
চাপের কূটনীতি
রুশ নিরাপত্তা পরিষদের বৈজ্ঞানিক উপদেষ্টা বোর্ডের সদস্য অ্যান্ড্রু সুশেন্তসভ মনে করেন, মার্কিন এই চাপ দীর্ঘস্থায়ী হবে না। তাঁর মতে, যুক্তরাষ্ট্র আগেও ভারতের ওপর বিদেশ নীতি চাপিয়ে দিতে চেয়েছিল, কিন্তু সফল হয়নি। এবারও ব্যর্থ হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। সুশেন্তসভ বলেন, ট্রাম্প ভারতের বিরুদ্ধে রাশিয়া থেকে তেল আমদানি করে ইউক্রেন যুদ্ধকে জিইয়ে রাখার অভিযোগ তুলেছেন, কিন্তু আসল কারণ কেবল তেল নয়। যুক্তরাষ্ট্র চায় ভারত তাদের নেতৃত্ব মেনে চলুক এবং স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতির পথে না হাঁটুক।
তিনি আরও বলেন, যুক্তরাষ্ট্র প্রায়ই বাণিজ্যকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে চাপ সৃষ্টি করে, কিন্তু যখন ব্যর্থ হয়, তখন আগের সিদ্ধান্ত বদলে নেয়। উদাহরণ হিসেবে ব্রাজিলের প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন, ট্রাম্প সেখানে বিরোধীদের সমর্থন দিয়ে হস্তক্ষেপ করেছিলেন, যা উল্টো প্রতিরোধ বাড়িয়েছে।
মার্কিন চাপের মধ্যেও রাশিয়া সফর
চাপ সত্ত্বেও ভারত–রাশিয়া সম্পর্কের উষ্ণতা কমেনি। ৬ আগস্ট ট্রাম্প ভারতের ওপর আরও ২৫ শতাংশ শুল্ক ঘোষণা করেন। ঠিক পরদিন ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভাল রাশিয়া পৌঁছে প্রেসিডেন্ট পুতিনের সঙ্গে বৈঠক করেন। তিনি জানান, চলতি বছরের শেষের দিকে পুতিন ভারত সফরে আসবেন। রুশ গণমাধ্যমও একই তথ্য প্রকাশ করেছে।
রাশিয়া সফরে দোভাল প্রতিরক্ষা সহযোগিতা, বিরল খনিজ আহরণ, বিমান যন্ত্রাংশ উৎপাদন ও রেলপথ উন্নয়নে অংশীদারত্ব জোরদারের বিষয়ে আলোচনা করেন। এস-৪০০ ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা কেনার বিষয়েও কথা হয়। বর্তমানে ভারতের কাছে তিনটি এস-৪০০ সিস্টেম রয়েছে, যা অপারেশন সিঁদুরের সময় ব্যবহৃত হয়েছিল।
রুশ মিডিয়া গ্রুপ ‘রুসিয়া সেগোদনায়া’র মহাপরিচালক দিমিত্রি কিসেলেভ বলেন, ভারত ও রাশিয়ার বন্ধুত্ব দুই দেশের জন্যই গুরুত্বপূর্ণ, আর এ সম্পর্কের ওপর কোনো চাপ সফল হবে না।
শুল্কের সময় ও প্রেক্ষাপট
মস্কো টাইমসের বিশ্লেষণ অনুযায়ী, ১৫ আগস্ট পুতিন ও ট্রাম্পের বৈঠকের আগে নতুন শুল্ক কার্যকর হবে না। ২৭ আগস্টের পর থেকে ৫০ শতাংশ শুল্ক কার্যকর হবে বলে জানা গেছে। মজার বিষয়, রাশিয়া থেকে তেল কেনার জন্য ভারত ছাড়া অন্য কোনো দেশকে টার্গেট করেনি যুক্তরাষ্ট্র।
লেই টার্নার, যিনি ২০০৮ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত ইউক্রেনে যুক্তরাজ্যের রাষ্ট্রদূত ছিলেন, বলেছেন—ভারতের বিরুদ্ধে এই পদক্ষেপ আসলে মার্কিন পররাষ্ট্রনীতির একটি বড় ইউ-টার্ন। কারণ, একসময় ট্রাম্প ইউক্রেনের প্রেসিডেন্টকে স্বৈরশাসক বলে অভিহিত করেছিলেন এবং পুতিনপন্থী অবস্থান নিয়েছিলেন।
সম্পর্কের ভবিষ্যৎ
বিশ্লেষকদের মতে, যুক্তরাষ্ট্র ভারতের ওপর এই চাপ মূলত কৌশলগত প্রভাব বিস্তারের প্রচেষ্টা। চীনের সঙ্গে সংঘাতের প্রেক্ষাপটে ভারতকে গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার মনে করে ওয়াশিংটন। তাই তারা চায় ভারত তাদের নীতি মেনে চলুক। তবে ভারতের দীর্ঘদিনের রাশিয়া–ঘনিষ্ঠ অবস্থান এবং বৈচিত্র্যময় পররাষ্ট্রনীতি যুক্তরাষ্ট্রের জন্য চ্যালেঞ্জ হয়ে থাকবে।
যদিও শুল্ক বৃদ্ধির ফলে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যে প্রভাব পড়তে পারে, তবু ভারত আপাতত রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক কমানোর কোনো ইঙ্গিত দিচ্ছে না। বরং প্রতিরক্ষা ও জ্বালানি খাতে সহযোগিতা আরও জোরদার করার পরিকল্পনা চলছে।
মার্কিন চাপ কতটা কার্যকর হবে, তা সময়ই বলবে। তবে বিশেষজ্ঞদের ধারণা, ইতিহাস যেমন দেখিয়েছে, ভারত নিজের স্বার্থেই স্বাধীন পথেই এগোবে—যত চাপই আসুক না কেন।