নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ও ক্ষুদ্রঋণের জনক অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস তাঁর জীবনের এই পর্যায়ে অবসরের শান্ত জীবন বেছে নিতে পারতেন। কিন্তু সময় ও পরিস্থিতি তাঁকে ভিন্ন পথে টেনে এনেছে। বর্তমানে তিনি বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্ব পালন করছেন। এই পদে তাঁর আগমন ছিল হঠাৎ, পরিকল্পিত নয়। তবে তিনি এটিকে ব্যক্তিগত উচ্চাকাঙ্ক্ষা নয় বরং দেশের মানুষের প্রতি দায়িত্ব ও কর্তব্য হিসেবে দেখছেন।
সম্প্রতি মালয়েশিয়া সফরকালে দেশটির জাতীয় সংবাদমাধ্যম বারনামা-কে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, “এটা আমার ব্যক্তিগত চাওয়া নয়। দেশের মানুষ পরিবর্তন চেয়েছে। তাঁদের আকাঙ্ক্ষা পূরণেই আমি কাজ করছি। যেভাবে তারা এগোতে চায়, আমি কেবল সেভাবেই সহায়তা করছি।”
পরিবর্তনের কেন্দ্রবিন্দুতে ইউনূস
বাংলাদেশে প্রায় দেড় দশক ধরে চলমান কর্তৃত্ববাদী রাজনীতির অবসানের পর জুলাইয়ের গণ–অভ্যুত্থান এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছে। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দীর্ঘ শাসনের অবসান ঘটে ৫ আগস্ট ২০২৪ সালে। এরপর ৮ আগস্ট রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন অর্থনীতিবিদ ও সামাজিক উদ্যোক্তা মুহাম্মদ ইউনূসকে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্ব দেন। ফলে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিবর্তনের কেন্দ্রবিন্দুতে চলে আসেন এই নোবেলজয়ী।
ইউনূস স্বীকার করেন, তিনি রাজনৈতিক ক্ষমতায় আসতে চাননি। ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রম, দারিদ্র্য বিমোচন এবং নারীর ক্ষমতায়নের মাধ্যমে তিনি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে পরিচিতি পেয়েছেন। কিন্তু দেশের রাজনৈতিক অস্থিরতা ও মানুষের প্রত্যাশা তাঁকে নেতৃত্বের আসনে বসিয়েছে। তাঁর ভাষায়, পরিস্থিতি তাঁকে বেশি বিকল্প দেয়নি।
সামনে বড় চ্যালেঞ্জ
নিজের ভূমিকাকে তিনি একজন রাজনৈতিক নেতার চেয়ে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার অভিভাবক হিসেবে ব্যাখ্যা করেন। সাক্ষাৎকারে তিনি স্পষ্ট করে বলেন, “এখানে অসুবিধা অনেক। অনেকেই এটিকে ব্যাহত করতে চায়। বাংলাদেশ থেকে বিতাড়িত রাজনৈতিক উপাদানগুলো এখনো পুরো ব্যবস্থাকে অস্থিতিশীল করার চেষ্টা করছে।”
তাঁর প্রধান দায়িত্ব হলো আগামী সাধারণ নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্যভাবে আয়োজন করা। ১৫ বছরের মধ্যে প্রথমবারের মতো বাংলাদেশে কোটি কোটি নতুন ভোটার ভোট দেওয়ার সুযোগ পাবেন। এ বিষয়ে ইউনূস বলেন, “ভাবুন, আপনার বয়স ১৮ বছর হয়েছে, ভোট দিতে চান। কিন্তু এত বছরেও সুযোগ পাননি। এখন তাঁরা অবশেষে প্রথমবার ভোট দিতে পারবেন।”
আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপট ও মালয়েশিয়া সফর
১১ থেকে ১৩ আগস্ট ২০২৫ পর্যন্ত তিনি মালয়েশিয়া সফর করেন প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিমের আমন্ত্রণে। সফরের শেষ দিনে বারনামাকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতি তুলে ধরেন। তিনি জানান, বাংলাদেশ রোহিঙ্গা সংকটসহ আঞ্চলিক নানা চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় মালয়েশিয়ার সমর্থন কাজে লাগাতে চায়।
মালয়েশিয়ায় অবস্থানকালে তিনি বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে সম্মানসূচক ডিগ্রি লাভ করেন এবং অর্থনৈতিক সহযোগিতা বাড়ানোর বিষয়ে আলোচনা করেন। তিনি প্রস্তাব দেন, বাংলাদেশ ও মালয়েশিয়া যৌথভাবে হালাল পণ্য উৎপাদনের মাধ্যমে বিশ্ববাজারে নিজেদের অবস্থান শক্ত করতে পারে।
ক্ষুদ্রঋণের পথিকৃৎ থেকে রাষ্ট্রনায়ক
১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষের সময় চরম দরিদ্র মানুষের পাশে দাঁড়াতে তিনি প্রথম ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রম শুরু করেন। মাত্র ২৭ ডলার দিয়ে ৪২টি পরিবারকে ঋণ প্রদান করেছিলেন। পরে ১৯৭৬ সালে চট্টগ্রামে একটি পাইলট প্রকল্পের মাধ্যমে গ্রামীণ ব্যাংক প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেন। ১৯৮৩ সালে এটি পূর্ণাঙ্গ ব্যাংক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে।
আজ গ্রামীণ ব্যাংকের গ্রাহক সংখ্যা এক কোটিরও বেশি। ব্যাংকের সদস্যদের ৯৭ শতাংশ নারী, যারা ক্ষুদ্রঋণের মাধ্যমে নিজেদের জীবন ও পরিবার গড়ে তুলেছেন। ২০০৬ সালে ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রমের জন্য অধ্যাপক ইউনূস নোবেল শান্তি পুরস্কারে ভূষিত হন।
গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের প্রত্যাশা
জুলাইয়ের গণ–অভ্যুত্থান দেশের মানুষের মনে পরিবর্তনের প্রত্যাশা জাগিয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে অধ্যাপক ইউনূস এখন সেই প্রত্যাশার প্রতীক হয়ে উঠেছেন। আগামী বছরের ফেব্রুয়ারিতে নির্ধারিত জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে তাঁর নেতৃত্ব বাংলাদেশকে নতুন দিকনির্দেশনা দিতে পারে।
তিনি বিশ্বাস করেন, গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া ফিরিয়ে আনাই এখন সবচেয়ে বড় লক্ষ্য। জনগণের দীর্ঘ প্রতীক্ষিত ভোটাধিকার নিশ্চিত করা ছাড়া তাঁর কোনো ব্যক্তিগত উচ্চাকাঙ্ক্ষা নেই।
অধ্যাপক ইউনূস বলেন, “এটা আমার নয়, এটা জনগণের। আমি কেবল তাঁদের পাশে থেকে সহযোগিতা করছি।”
বাংলাদেশের ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায় শুরু হয়েছে, যেখানে একসময় দরিদ্র মানুষের সহায়তায় ক্ষুদ্রঋণ চালু করা মানুষটিই এখন গণতন্ত্রের পুনর্জাগরণের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। সামনে তাঁর যাত্রাপথ কঠিন হলেও মানুষের বিশ্বাস ও আস্থাই তাঁকে শক্তি জোগাচ্ছে।