গুজরাটের সুরাটে আলোর উৎসব দীপাবলির আগে উৎসবের আলো নিভে যেতে বসেছে। দীর্ঘ আট বছর ধরে প্রাকৃতিক হীরা কাটিং ও পালিশের ব্যবসা চালিয়ে আসা ৩৫ বছর বয়সী কালপেশ প্যাটেল জানেন না, এ বছর উৎসবের শেষে তাঁর কারখানার দরজা আর খুলবে কি না। প্রায় ৪০ জন কর্মী নিয়ে ছোট্ট এই কারখানায় বিদেশে রপ্তানির জন্য অমসৃণ হীরা প্রক্রিয়াজাত করা হয়। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে ৫০ শতাংশ শুল্ক আরোপের সিদ্ধান্ত তাঁর ব্যবসার জন্য ‘শেষ কফিনের পেরেক’ হয়ে দাঁড়াতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন তিনি।
গত কয়েক বছর ধরেই প্রাকৃতিক হীরাশিল্প নানা চাপে রয়েছে। কোভিড-১৯ মহামারি, রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধ, পশ্চিমাদের নিষেধাজ্ঞা এবং বাজারে ল্যাব-উৎপাদিত সস্তা হীরার আগমনে এই খাতের চাহিদা ক্রমশ কমছে। এর ওপর যুক্তরাষ্ট্রের নতুন শুল্ক ব্যবসায়ীদের আরও সঙ্কটে ফেলেছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প গত ২ এপ্রিল ভারতীয় পণ্যে ২৫ শতাংশ পাল্টা শুল্ক আরোপের ঘোষণা দেন। আলোচনার পরও বাণিজ্য চুক্তি না হওয়ায় ৭ আগস্ট থেকে তা কার্যকর হয়। এরপর ৬ আগস্ট তিনি আরও ২৫ শতাংশ শুল্ক যোগ করেন, ফলে মোট শুল্কের হার দাঁড়ায় ৫০ শতাংশ। পূর্বের ২.১ শতাংশ শুল্কসহ এটি এখন ৫২.১ শতাংশে পৌঁছেছে।
সুরাটের ‘হীরা নগরী’ বিপদে
বিশ্বে উত্তোলিত প্রতি ১৫টি প্রাকৃতিক হীরার মধ্যে ১৪টিরই কাটিং ও পালিশ হয় সুরাটে। জেম অ্যান্ড জুয়েলারি এক্সপোর্ট প্রমোশন কাউন্সিল (জিজেইপিসি) জানায়, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ভারত যুক্তরাষ্ট্রে ৪৮০ কোটি ডলারের প্রক্রিয়াজাত হীরা রপ্তানি করেছে, যা দেশের মোট রপ্তানির এক-তৃতীয়াংশেরও বেশি। পুরো অর্থবছরে বিশ্ববাজারে ভারতের রপ্তানি হয়েছে ১ হাজার ৩২০ কোটি ডলারের প্রক্রিয়াজাত হীরা।
কিন্তু এখন ক্রয়াদেশ বাতিল হচ্ছে, চালান ফেরত আসছে। কলকাতার রপ্তানিকারক ডিম্পল শাহ বলেন, “দুই দশকের ক্যারিয়ারে এত খারাপ সময় দেখিনি।” যুক্তরাষ্ট্রের ক্রেতারা বেশি শুল্কের কারণে পণ্য জাহাজ থেকে তুলতে চাইছে না।
বিপন্ন শ্রমিকজীবন
গুজরাটের সুরাট, আহমেদাবাদ ও রাজকোটে প্রায় ২০ লাখ মানুষ হীরাশিল্পে কাজ করেন। গত দুই বছরে অর্থনৈতিক সঙ্কটে শুধু এই খাতেই ৮০ জন শ্রমিক আত্মহত্যা করেছেন বলে জানায় ডায়মন্ড ওয়ার্কার্স ইউনিয়ন। মাসিক বেতন অনেকের ক্ষেত্রে অর্ধেকে নেমে এসেছে—এখন তা ১৫ থেকে ১৭ হাজার রুপির মধ্যে। ইউনিয়নের সভাপতি রমেশ জিলরিয়া বলেন, “যদি শুল্ক পুরোপুরি কার্যকর হয়, প্রায় ২ লাখ শ্রমিক জীবিকা হারাতে পারেন।” ইতিমধ্যে ১ লাখ ২০ হাজারের বেশি সাবেক শ্রমিক সরকারি ভাতা চেয়ে আবেদন করেছেন।
শিল্পের কাঠামোগত চ্যালেঞ্জ
শুধু শুল্ক বা যুদ্ধ নয়, ল্যাব-উৎপাদিত হীরার ক্রমবর্ধমান বাজারও প্রাকৃতিক হীরার বিক্রি কমাচ্ছে। এই কৃত্রিম হীরার দাম প্রাকৃতিক হীরার মাত্র ১০ শতাংশ এবং চোখে দেখে পার্থক্য ধরা কঠিন। সস্তা দাম ও সহজলভ্যতার কারণে অনেক গ্রাহক এখন কৃত্রিম হীরার দিকেই ঝুঁকছেন।
২০২৪-২৫ অর্থবছরে ভারতের অমসৃণ হীরা আমদানি কমেছে ২৪.২৭ শতাংশ—১ হাজার ৮০ কোটি ডলারে নেমেছে আগের বছরের ১ হাজার ৪০০ কোটি ডলার থেকে। একই সময়ে প্রক্রিয়াজাত হীরার রপ্তানি ১৬.৭৫ শতাংশ কমে দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৩২০ কোটি ডলারে।
অর্থনীতিতে সম্ভাব্য ধাক্কা
জিজেইপিসির চেয়ারম্যান কিরিট বানসালি সতর্ক করে বলেছেন, উচ্চ শুল্কের কারণে সরবরাহ শৃঙ্খল ব্যাহত হতে পারে, রপ্তানি থমকে যেতে পারে এবং হাজারো মানুষের জীবিকা হুমকির মুখে পড়তে পারে। অল ইন্ডিয়া জেমস অ্যান্ড জুয়েলারি ডোমেস্টিক কাউন্সিলের চেয়ারম্যান রাজেশ রোকদে মনে করেন, যুক্তরাষ্ট্রে প্রায় ৭০ হাজার গয়নার দোকানও এর প্রভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
নতুন বাজারের সন্ধান
ব্যবসায়ীরা বলছেন, এই সংকট মোকাবিলায় দেশীয় বাজারে চাহিদা বাড়ানো এবং লাতিন আমেরিকা, মধ্যপ্রাচ্যের মতো নতুন বাজারে প্রবেশ করা জরুরি। ভারতের অভ্যন্তরীণ রত্ন ও গয়নার বাজার বর্তমানে ৮ হাজার ৫০০ কোটি ডলার, যা দুই বছরের মধ্যে ১৩ হাজার কোটি ডলারে পৌঁছানোর আশা করা হচ্ছে।
বারানসির নারায়ণ দাস সরাফ জুয়েলার্সের পরিচালক রাধা কৃষ্ণ আগারওয়াল মনে করেন, “শক্তিশালী অভ্যন্তরীণ বাজার শুধু স্থানীয় অর্থনীতিকে নয়, হাজারো মানুষের কর্মসংস্থানও নিশ্চিত করবে।” তাঁর মতে, বিদেশ নির্ভরতা কমাতে পারলে এই শুল্ক ‘গোপনে আশীর্বাদ’ হিসেবেও কাজ করতে পারে।
অবস্থান ও অনিশ্চয়তা
সুরাট জুয়েলারি ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি অমিত কোরাট মনে করেন, সোনার বাজার যেমন দেশীয় চাহিদায় শক্ত অবস্থানে রয়েছে, তেমনি হীরাশিল্পের জন্যও সেই রকম সুরক্ষা দরকার। কিন্তু আপাতত তেমন কোনো সুরক্ষাবলয় নেই।
কালপেশ প্যাটেলের মতো ছোট ব্যবসায়ীরা বলছেন, সরকারি সহায়তা ছাড়া এই শিল্প তার জৌলুশ হারাবে। দীপাবলির আলো হয়তো এ বছর জ্বলবে, কিন্তু সুরাটের অনেক কারখানায় তা নিভে যেতে পারে চিরতরে।