জাপানের প্রধানমন্ত্রী শিগেরু ইশিবা আজ রোববার পদত্যাগ করতে যাচ্ছেন বলে তাঁর ঘনিষ্ঠ একটি সূত্র জানিয়েছে। বিশ্বের চতুর্থ বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ জাপান যখন রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অস্থিরতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, তখন তাঁর পদত্যাগ দেশটিকে দীর্ঘ নীতিগত অচলাবস্থার দিকে ঠেলে দিতে পারে।
সরকারি কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, রোববার সন্ধ্যা ৬টায় (গ্রিনিচ সময় সকাল ৯টা) সংবাদ সম্মেলন করবেন ইশিবা (৬৮)। তবে তিনি সত্যিই পদত্যাগ করবেন কি না, সে বিষয়ে তাঁর কার্যালয় কোনো মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে। এই অনিশ্চয়তার কারণে জাপানের রাজনৈতিক অঙ্গনে চরম অস্থিরতা তৈরি হয়েছে।
ক্ষমতায় আসার পর থেকে পরাজয়ের ধারা
সাবেক প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইশিবা মাত্র এক বছরেরও কম সময় আগে প্রধানমন্ত্রী হন। কিন্তু দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই তাঁর নেতৃত্বাধীন জোট সরকার সংসদের দুই কক্ষের নির্বাচনে একের পর এক পরাজয়ের মুখ দেখেছে। এর ফলে জাপানের শাসকদল লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি (এলডিপি) সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারিয়েছে।
বিশ্লেষকেরা বলছেন, ক্রমবর্ধমান জীবনযাত্রার ব্যয়ে ক্ষুব্ধ জনগণই ইশিবার সরকারের প্রতি আস্থা হারিয়েছে। দৈনন্দিন নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যাওয়ায় সাধারণ মানুষ সরকারের নীতিকে দায়ী করছে।
দলীয় চাপ ও অভ্যন্তরীণ সংকট
গত জুলাই মাসে উচ্চকক্ষের নির্বাচনে পরাজয়ের দায় নিয়ে ইশিবাকে পদত্যাগ করার আহ্বান জানিয়েছিল এলডিপি। যুদ্ধ-পরবর্তী প্রায় পুরো সময় ধরে জাপান শাসন করেছে এই দল। কিন্তু ইশিবা দলীয় সেই আহ্বান প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। বরং তিনি মনোযোগ দেন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে শুল্কসংক্রান্ত বাণিজ্যচুক্তি চূড়ান্ত করার দিকে।
শুল্ক নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দীর্ঘদিন ধরে টানাপোড়েন চলছিল, যা জাপানের গুরুত্বপূর্ণ গাড়িশিল্পকে নড়বড়ে করে তুলেছে। তবে ইশিবার কূটনৈতিক প্রচেষ্টা দলীয় ক্ষোভ প্রশমিত করতে পারেনি।
অর্থনীতির টালমাটাল পরিস্থিতি
রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার পাশাপাশি অর্থনীতিতেও ধস নেমেছে। গত সপ্তাহে জাপানি মুদ্রা ইয়েন ও সরকারি বন্ড বাজারে বড় ধরনের পতন ঘটে। গত বুধবার ৩০ বছরের বন্ডের মুনাফার হার ইতিহাসের সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছায়।
মেইজি ইয়াসুদা রিসার্চ ইনস্টিটিউটের অর্থনীতিবিদ কাজুতাকা মায়েদা বলেন, “এলডিপির ধারাবাহিক নির্বাচনী পরাজয়ের পর ইশিবার ওপর যে রাজনৈতিক চাপ তৈরি হয়েছিল, তাঁর পদত্যাগ অবশ্যম্ভাবী ছিল।” তিনি আরও জানান, ইশিবার সম্ভাব্য উত্তরসূরিদের মধ্যে শিনজিরো কোইজুমি ও সানায়ে তাকাইচি এখন সবচেয়ে বেশি আলোচনায় রয়েছেন।
সম্ভাব্য উত্তরসূরি ও রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ
শিনজিরো কোইজুমি—এক অভিজ্ঞ রাজনৈতিক পরিবারের উত্তরসূরি, যিনি ইশিবার কৃষিমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তাঁর ওপর দায়িত্ব ছিল মূল্যবৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণের। কোইজুমি তরুণ ও আকর্ষণীয় রাজনীতিক হিসেবে জনগণের মধ্যে জনপ্রিয়। তবে বিশ্লেষকেরা মনে করেন, তিনি বড় ধরনের নীতিগত পরিবর্তন আনবেন না।
অন্যদিকে সানায়ে তাকাইচি সরকারি ব্যয় বাড়ানোর পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন এবং সুদের হার বাড়ানো বিষয়ে সতর্ক মনোভাব দেখাচ্ছেন। আর্থিক বাজার তাঁর নীতির প্রতি নিবিড়ভাবে নজর রাখছে।
তবে আইনসভার কোনো কক্ষেই এলডিপির সংখ্যাগরিষ্ঠতা নেই। ফলে দলীয় নতুন সভাপতি স্বয়ংক্রিয়ভাবে প্রধানমন্ত্রী হবেন—এমন নিশ্চয়তা নেই। বিশ্লেষকেরা বলছেন, নতুন নেতা চাইলে আইনসভা ভেঙে আগাম নির্বাচন ডাকতে পারেন। যদিও বিরোধী দলগুলো বিভক্ত, তবে ডানপন্থী ও অভিবাসনবিরোধী ‘সানসেইতো’ পার্টি গত জুলাইয়ের উচ্চকক্ষের নির্বাচনে উল্লেখযোগ্য সাফল্য পেয়েছে।
জনমত ও নির্বাচন নিয়ে অনিশ্চয়তা
রোববার কিয়োদো সংবাদ সংস্থার প্রকাশিত এক জনমতে দেখা গেছে, ৫৫ শতাংশ উত্তরদাতা মনে করেন, এখনই আগাম নির্বাচন করা উচিত নয়। জনগণের বড় একটি অংশ বর্তমান অস্থিরতার মধ্যে আরও একটি নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় যেতে অনিচ্ছুক।
পদত্যাগের আগে শেষ কাজ
যদি শিগেরু ইশিবা প্রত্যাশিতভাবে পদত্যাগ করেন, তবে তাঁর শেষ কাজ হবে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্যচুক্তির বিস্তারিত চূড়ান্ত করা। ওই চুক্তিতে জাপান ৫৫০ বিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। এর বিনিময়ে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প জাপানের গাড়ি শিল্পের ওপর শুল্ক কমানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।
এই চুক্তি ইশিবার সরকারের অন্যতম বড় কূটনৈতিক সাফল্য হিসেবে বিবেচিত হলেও রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে তা দেশের অর্থনীতিকে কতটা উপকার করবে, তা এখনো অনিশ্চিত।