কানাডায় একের পর এক হত্যাকাণ্ড, ভারতীয় বিষ্ণোই গ্যাংকে সন্ত্রাসী সংগঠন ঘোষণার দাবি

২০২৪ সালের ১৪ মে। কানাডার অন্টারিও প্রদেশের ব্রাম্পটনের বাসিন্দা হারজিৎ সিং ধাড্ডা প্রতিদিনের মতোই মাথায় সবুজ পাগড়ি পরে কর্মস্থলে যাওয়ার প্রস্তুতি নেন। মেয়ে গুরলীনকে জড়িয়ে বিদায় জানানোর পর তিনি মিসিসাগায় কর্মস্থলের উদ্দেশে রওনা দেন। কিন্তু সেটিই ছিল বাবার সঙ্গে গুরলিনের শেষ দেখা। কর্মস্থলের পার্কিংয়ে পৌঁছানো মাত্র দুই ব্যক্তি তাকে আটকায়। তাদের মধ্যে একজন হারজিৎকে একাধিক গুলি করে এবং চুরি করা গাড়িতে পালিয়ে যায়। হাসপাতালে নেওয়ার পর হারজিৎ মারা যান।

কয়েক ঘণ্টা পর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দুই ব্যক্তি হত্যার দায় স্বীকার করে নিজেদের ভারতের কুখ্যাত লরেন্স বিষ্ণোই গ্যাংয়ের সদস্য বলে দাবি করে। ঘটনার এক মাসের মধ্যে ব্রিটিশ কলাম্বিয়ার সারে এবং ব্রাম্পটনে আরও দুই ভারতীয় বংশোদ্ভূত ব্যবসায়ী গুলিতে নিহত হন। স্থানীয় কর্তৃপক্ষ বলছে, এটি ভারতের অপরাধী চক্রগুলোর কানাডায় সক্রিয় হয়ে ওঠার ভয়ংকর প্রমাণ।

প্রায় ৭ লাখ ৭০ হাজার শিখের বসবাস কানাডায়, যা মোট জনসংখ্যার ২.১ শতাংশ। ভারতের বাইরে কানাডাতেই সবচেয়ে বেশি শিখ বাস করেন। ১৯৮০-এর দশকে পাঞ্জাবে খালিস্তান আন্দোলনের দমনপীড়নের সময় বহু শিখ কানাডায় আশ্রয় নেন। এখন বিষ্ণোই গ্যাংকে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে ঘোষণা করার দাবি উঠছে প্রবলভাবে।

ব্রিটিশ কলাম্বিয়ার মুখ্যমন্ত্রী ডেভিড ইবি ও আলবার্টার মুখ্যমন্ত্রী ড্যানিয়েল স্মিথসহ একাধিক রাজনৈতিক নেতা বলছেন, সন্ত্রাসী হিসেবে তালিকাভুক্ত হলে পুলিশ বাড়তি ক্ষমতা পাবে, গ্যাংয়ের আর্থিক উৎস বন্ধ করা ও সদস্যদের ওপর নজরদারি করা সম্ভব হবে। আইন অনুযায়ী তখন গ্যাংয়ে যোগদান, আর্থিক সহায়তা, এমনকি প্রচারও অপরাধ হবে।

অন্টারিওর কুইন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক অমরনাথ অমারাসিংহামের মতে, সন্ত্রাসী তালিকাভুক্তির ফলে ইন্টারপোলসহ আন্তর্জাতিক সংস্থার মাধ্যমে গ্রেপ্তারি অভিযান জোরদার হবে, সম্পদ বাজেয়াপ্ত, ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা ও সহযোগীদের কালো তালিকাভুক্ত করাও সম্ভব হবে। তবে তিনি সতর্ক করেছেন, গোষ্ঠীটির রাজনৈতিক বা আদর্শগত লক্ষ্য স্পষ্ট নয়, যা সন্ত্রাসী ঘোষণা প্রক্রিয়ায় একটি আইনি চ্যালেঞ্জ হতে পারে।

২০২৩ সালের জুনে শিখ নেতা হরদীপ সিং নিজ্জর কানাডায় খুন হওয়ার পর থেকেই বিষ্ণোই গ্যাং কানাডা-ভারত কূটনৈতিক দ্বন্দ্বের কেন্দ্রে রয়েছে। কানাডা অভিযোগ করেছে, ভারতীয় গোয়েন্দারা বিদেশে খালিস্তানপন্থীদের নিশানা করছে এবং বিষ্ণোই গ্যাং তাদের হয়ে কাজ করছে। ভারত এ অভিযোগ অস্বীকার করে বলেছে, বরং তারা গ্যাং সদস্যদের প্রত্যর্পণ চেয়ে কানাডাকে একাধিক অনুরোধ পাঠিয়েছে, কিন্তু সাড়া মেলেনি।

এদিকে দক্ষিণ এশীয় কমিউনিটির মধ্যে আতঙ্ক বেড়েছে। ব্রিটিশ কলাম্বিয়ার সারের ব্যবসায়ী সতীশ কুমার জানান, তিনি চাঁদাবাজি ও প্রাণনাশের হুমকি পেয়েছেন। হুমকি অমান্য করায় তার তিনটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে গুলি চালানো হয়েছে। সতীশ ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, “ওরা যেকোনো সময় আমাকে মেরে ফেলতে পারে, পুলিশ পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নিচ্ছে না।”

কানাডা পুলিশের তথ্য অনুযায়ী, ব্রিটিশ কলাম্বিয়ায় ২০০৩ সালে মোট হত্যাকাণ্ডের ২১ শতাংশ ছিল গ্যাং-সংক্রান্ত, যা ২০২৩ সালে বেড়ে ৪৬ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। ফলে সারে ও ব্রাম্পটনে দক্ষিণ এশীয়দের মধ্যে নিজেদের নিরাপত্তা নিয়ে ভয় বাড়ছে।

বিশ্লেষকদের মতে, বিষ্ণোই গ্যাংকে সন্ত্রাসী ঘোষণা শুধু কানাডার ভেতরেই নয়, আন্তর্জাতিক পর্যায়েও বার্তা দেবে যে দেশটি বিদেশি অপরাধী চক্রের হুমকিকে গুরুত্ব দিচ্ছে। একই সঙ্গে এটি ভারতসহ মিত্র দেশগুলোর সঙ্গে গোয়েন্দা তথ্য বিনিময় ও যৌথ অভিযান পরিচালনার পথ আরও সুগম করবে।

Share With Your Friends

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *