ইসরায়েল প্রশ্নে কেন মোদির অবস্থান নরম, কড়া সমালোচনা কংগ্রেসের

ভারতের রাজনীতিতে পান থেকে চুন খসলে হইচই শুরু হয়। অথচ রাষ্ট্রীয় সংকটের সময় বিরোধিতা ভুলে সবাই সরকারের পাশে দাঁড়ায়। রাজনৈতিক আচরণের এই বৈপরীত্যই ভারতের পররাষ্ট্রনীতির চিরকালীন বিশেষত্ব। পেহেলগাম–কাণ্ড ও ‘অপারেশন সিদুঁর’ নাম দিয়ে পাকিস্তানে হামলার পর দেড় মাস সেই ধারাবাহিকতা বজায় থাকলেও এখন আবার শুরু হয়েছে সরকারবিরোধীদের পারস্পরিক সমালোচনা ও আকচা-আকচি পর্ব। বিরোধিতা শুরু হয়েছে নরেন্দ্র মোদি সরকারের ‘ইসরায়েল নীতি’ নিয়ে।

প্রধান বিরোধী দল কংগ্রেস তীব্র সমালোচনা করেছে ভারতের এই ‘ধরি মাছ না ছুঁই পানি’ নীতির। গাজায় ইসরায়েলের হামলা বন্ধ ও নিঃশর্ত যুদ্ধবিরতি এবং ইসরায়েলের তীব্র নিন্দা করে গত শনিবার জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে যে প্রস্তাব পাস হয়, ভারত সেই ভোটাভুটিতে অংশ নেয়নি। স্পেনের আনা ওই প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দিয়েছে ১৪৯টি দেশ, বিপক্ষে ১২টি। যে ১৯টি দেশ ভোটদানে বিরত থেকেছে, ভারত তাদের অন্যতম।

ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘাত ভারতের কাছে বরাবরই স্পর্শকাতর। মোদির ভারত ২০২৩ সালেও এমনই এক প্রস্তাবে ভোটদানে বিরত ছিল। হামাসের বিরোধিতা করেও ইসরায়েলের উদ্দেশে মোদির ভারত ‘আন্তর্জাতিক আইন মানা ও মানবিকতার মর্যাদা রক্ষার’ কথা বলেছিল। এবারও তেমনই এক প্রস্তাব উপস্থাপন হলো সেই সময়, যখন গাজা থেকে দৃষ্টি সরিয়ে ইসরায়েল নজর দিয়েছে ইরানের দিকে। ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘাতের মতোই স্পর্শকাতর ইসরায়েল-ইরান যুদ্ধ। এ যুদ্ধে ভারত ‘শ্যাম রাখি না কুল’—সেই নির্ণয় এখনো করে উঠতে পারেনি।

কংগ্রেস সভাপতি খাড়গে বলেছেন, ‘এখন এটা স্পষ্ট যে আমাদের পররাষ্ট্রনীতি টুকরা টুকরা হয়ে যাচ্ছে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী ব্যর্থ। ব্যর্থতার মোকাবিলায় প্রধানমন্ত্রীর উচিত উপযুক্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া।’ তিনি জানতে চান, পশ্চিম এশিয়ায় যুদ্ধবিরতি ও শান্তি আলোচনা নিয়ে ভারত তার চিরায়ত অবস্থান থেকে সরে এসেছে কি না।

আর এ সময়েই সমালোচনা তীব্র করে তুলেছে কংগ্রেস। প্রধান বিরোধী দলের সভাপতি মল্লিকার্জুন খাড়গে, কেরালার ওয়েনাডের সংসদ সদস্য প্রিয়াঙ্কা গান্ধী ভদ্র ও কংগ্রেস মুখপাত্র জয়রাম রমেশ প্রত্যেকেই সরকারি মনোভাব ও ভূমিকার সমালোচনা করে বলেছেন, বিশ্বগুরু হতে গেলে সাহসী হতে হয়। মানবিক কণ্ঠস্বর ফিরিয়ে আনতে হয়।

খাড়গে বলেছেন, ‘এখন এটা স্পষ্ট যে আমাদের পররাষ্ট্রনীতি টুকরা টুকরা হয়ে যাচ্ছে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী ব্যর্থ। ব্যর্থতার মোকাবিলায় প্রধানমন্ত্রীর উচিত উপযুক্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া।’ তিনি জানতে চান, পশ্চিম এশিয়ায় যুদ্ধবিরতি ও শান্তি আলোচনা নিয়ে ভারত তার চিরায়ত অবস্থান থেকে সরে এসেছে কি না।

খাড়গের মতো নরম সুরে সরকারকে বিদ্ধ করেননি প্রিয়াঙ্কা। ওয়েনাডের সংসদ সদস্য অনেক খোলাখুলি সমালোচনা করেছেন ভারত সরকারের। জাতিসংঘের প্রস্তাবে সমর্থন না জানিয়ে ভারতের ভোটদানে বিরত থাকার নীতি ‘লজ্জাজনক ও হতাশজনক’ মন্তব্য করে প্রিয়াঙ্কা ‘এক্স’ হ্যান্ডলে লিখেছেন, যেখানে ৬০ হাজার মানুষ ইতিমধ্যেই মারা গেছেন, যাঁদের মধ্যে বেশির ভাগ শিশু ও নারী, যেখানে মানুষকে না খেতে দিয়ে হত্যাযজ্ঞ চালানো হচ্ছে, সেখানে ভারত মৌন।

শুধু গাজা সংহার নয়, ইরানে ইসরায়েলের আক্রমণের বিরুদ্ধে সাংহাই কো-অপারেশন অর্গানাইজেশন (এসসিও) যে বিবৃতি জারি করেছে, ভারত তারও অংশীদার হয়নি। মোট ৯ দেশের গোষ্ঠী এসসিওতে ভারত ও ইরান দুই দেশই রয়েছে।

ইরানকে টেনে এনে প্রিয়াঙ্কা লিখেছেন, ভারত শুধু নীরবই নয়, ইসরায়েলের ইরান আক্রমণকে কার্যত সমর্থনও করেছে। এ ভূমিকা ভারতের স্বাধীনতাসংগ্রাম ও সাংবিধানিক আদর্শের পরিপন্থী। সত্য ও অহিংসার পক্ষে ভয়হীনভাবে দাঁড়ানো এই সন্ধিক্ষণের দাবি। অতীতে বারবার ভারত সেই সাহস দেখিয়েছে। বৈশ্বিক নেতৃত্ব দিতে গেলে ভারতকে সেই মানবিক কণ্ঠস্বর ফিরিয়ে আনতে হবে।

শুধু গাজা সংহার নয়, ইরানে ইসরায়েলের আক্রমণের বিরুদ্ধে সাংহাই কো-অপারেশন অর্গানাইজেশন (এসসিও) যে বিবৃতি জারি করেছে, ভারত তারও অংশীদার হয়নি। মোট ৯ দেশের গোষ্ঠী এসসিওতে ভারত ও ইরান দুই দেশই রয়েছে। এ গোষ্ঠীর বিবৃতির শরিক না হয়ে ভারত ‘ধরি মাছ না ছুঁই পানি’ তুল্য পৃথক বিবৃতি জারি করেছে, যার মোদ্দাকথা, আলোচনা ও কূটনৈতিক পদক্ষেপের মধ্য দিয়েই মীমাংসায় পৌঁছাতে হবে।

কংগ্রেস মুখপাত্র জয়রাম রমেশ সেই মানসিকতার সমালোচনা করে বলেছেন, এই বিবৃতি অর্থহীন। বিবৃতিটি পড়লে মনে হয়, যেন ইরান আক্রান্ত হলেও তাকে সংযম দেখাতে হবে। মনে হয়, ভারত যেন ইসরায়েলের হয়ে মিনমিন করে ক্ষমা চাইছে।

ইসরায়েলের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক দিন দিন ‘উন্নত’ হচ্ছে। দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতার ক্ষেত্র কৃষি, প্রযুক্তি, প্রতিরক্ষাসহ বিভিন্ন দিকে প্রসারিত হচ্ছে। সবচেয়ে বড় কথা, পাকিস্তানে হামলার সময় ইসরায়েলই প্রথম ভারতের আত্মরক্ষার অধিকারের কথা বলেছিল। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ভারতের ভূমিকাকে সমর্থন করেছিল।

ইসরায়েলের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক দিন দিন ‘উন্নত’ হচ্ছে। দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতার ক্ষেত্র কৃষি, প্রযুক্তি, প্রতিরক্ষাসহ বিভিন্ন দিকে প্রসারিত হচ্ছে। সবচেয়ে বড় কথা, পাকিস্তানে হামলার সময় ইসরায়েলই প্রথম ভারতের আত্মরক্ষার অধিকারের কথা বলেছিল। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ভারতের ভূমিকাকে সমর্থন করেছিল। এ ছাড়া ভারতের বিবেচনায় রয়েছে ইসরায়েল-যুক্তরাষ্ট্র ঘনিষ্ঠ সম্পর্কও। আন্তর্জাতিক মঞ্চে ইসরায়েলের খোলাখুলি বিরোধিতা মোদির ভারতের পক্ষে যে সম্ভবপর নয়, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নিভৃত আলোচনায় তা স্পষ্ট।

কংগ্রেসের এই পররাষ্ট্রনীতির বিরোধিতা বিজেপির পক্ষে রাজনৈতিক দিক থেকেও সহায়ক। বিজেপি মনে করে, সংখ্যালঘু সমর্থনের দিকটি মাথায় রেখেই ফিলিস্তিনি আবেগকে কংগ্রেস হাতিয়ার করতে চাইছে। ইসরায়েলের বিরোধিতা এবং ফিলিস্তিন ও ইরানের পাশে দাঁড়িয়ে কংগ্রেস সংখ্যালঘু ভোটে মেরুকরণ ঘটাতে চাইলে পরোক্ষে তা বিজেপির হিন্দুত্ববাদের পালেই হাওয়া দেবে।

বিজেপি মনে করছে, কংগ্রেস এই আবেগকে আঁকড়ে ধরতে চাইছে বিহার বিধানসভার ভোটের কথা মাথায় রেখে। শুধু ফিলিস্তিন-ইরানই নয়, সংখ্যালঘু আবেগের জন্যই কংগ্রেস ওয়াক্ফ আইনেরও বিরোধিতা করেছে। এই মনোভাব যত জোরালো হবে, ভোট আবহে বিজেপির হিন্দুত্ববাদী মেরুকরণও তত গতি পাবে।

পেহেলগাম–কাণ্ড ও পাকিস্তানে হামলার দেড় মাস পর ভারতীয় পররাষ্ট্রনীতির ‘সাফল্য’ বা ‘ব্যর্থতা’ ঘিরে ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক আবহ আবার ফিরে এসেছে তার চেনা পরিসরে।

Share With Your Friends

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *