ইসলাম ধর্মের পাঁচটি মূল ভিত্তির তৃতীয় স্তম্ভ হলো রোজা। রোজার আভিধানিক অর্থ হলো ‘সিয়াম’, যার অর্থ সংযম বা বিরত থাকা। ইসলামি শরিয়তের পরিভাষায়, সুবহে সাদিক বা ভোরের সূক্ষ্ম আলো থেকে শুরু করে সূর্যাস্ত পর্যন্ত সকল প্রকার পানাহার, পাপাচার, কামাচার এবং যাবতীয় ভোগ-বিলাস থেকে বিরত থাকার নামই রোজা। এটি আত্মশুদ্ধি, ধৈর্য, সংযম ও তাকওয়া অর্জনের এক অনন্য মাধ্যম।
রমজান মাস সমগ্র মুসলিম উম্মাহর জন্য এক বিশেষ নিয়ামত ও বরকতের মাস। এটি ক্ষমার মহান বার্তা নিয়ে সমহিমায় হাজির হয়। এই মাস রহমত, মাগফিরাত ও নাজাতের মাস হিসেবে পরিগণিত। এ মাসে প্রতিটি ইবাদতের প্রতিদান বহুগুণে বেড়ে যায়। এটি কল্যাণময় মাস, যে মাসে পবিত্র আল-কোরআন নাজিল হয়েছিল। রমজান শুধু উপবাসের নাম নয়, বরং এটি সংযম, আত্মশুদ্ধি ও তাকওয়া অর্জনের মাস। এটি মানুষকে সব ধরনের পাপাচার ও অপবিত্রতা থেকে মুক্ত করে এবং আত্মশুদ্ধির এক মহাসুযোগ করে দেয়। আল্লাহ তাআলা কোরআনে বলেন,
“রমাযান মাস- যার মধ্যে কুরআন নাযিল করা হয়েছে লোকেদের পথ প্রদর্শক এবং হিদায়াতের সুস্পষ্ট বর্ণনারূপে এবং সত্য-মিথ্যার পার্থক্যকারীরূপে, কাজেই তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি এ মাস পাবে, সে যেন এ মাসে রোযা পালন করে আর যে পীড়িত কিংবা সফরে আছে, সে অন্য সময় এ সংখ্যা পূরণ করবে, আল্লাহ তোমাদের জন্য যা সহজ তা চান, যা কষ্টদায়ক তা চান না যেন তোমরা মেয়াদ পূর্ণ করতে পার, আর তোমাদেরকে সৎপথে পরিচালিত করার কারণে তোমরা আল্লাহর মাহাত্ম্য ঘোষণা কর, আর যাতে তোমরা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে পার।” (সুরা বাকারা, আয়াত : ১৮৫)
রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন,
“আবূ হুরাইরাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত। আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ যে কেউ আল্লাহর পথে জোড়া জোড়া ব্যয় করবে তাকে জান্নাতের দরজাসমূহ হতে ডাকা হবে, হে আল্লাহর বান্দা! এটাই উত্তম। অতএব যে সালাত?আদায়কারী, তাকে সালাতের দরজা হতে ডাকা হবে। যে মুজাহিদ, তাকে জিহাদের দরজা হতে ডাকা হবে। যে সিয়াম পালনকারী, তাকে রাইয়্যান দরজা হতে ডাকা হবে। যে সাদাকা দানকারী, তাকে সাদাকার দরজা হতে ডাকা হবে। এরপর আবূ বকর (রাঃ) বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! আপনার জন্য আমার পিতা-মাতা কুরবান হোক, সকল দরজা হতে কাউকে ডাকার কোন প্রয়োজন নেই, তবে কি কাউকে সব দরজা হতে ডাকা হবে? আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেনঃ হাঁ। আমি আশা করি তুমি তাদের মধ্যে হবে।” (২৭৪১, ৩২১৬, ৩৬৬৬, মুসলিম ১২/২৭, হাঃ ১০২৭, আহমাদ ৭৬৩৭)
রমজান মাসে রোজা পালন করা ফরজ
রমজান মাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত হলো রোজা পালন করা। প্রত্যেক মুসলিম, যারা শারীরিকভাবে সক্ষম, প্রাপ্তবয়স্ক এবং সুস্থ, তাদের জন্য রোজা রাখা ফরজ।
তবে কিছু ব্যক্তি বিশেষ কারণে রোজা না রাখার অনুমতি পেতে পারেন:
১. ঋতুমতী নারী ও প্রসূতি মা – তারা স্রাবকালীন বা সন্তান প্রসবের সময় রোজা রাখতে বাধ্য নন। তবে পরে কাজা করে নিতে হবে।
- অসুস্থ ব্যক্তি – যদি কেউ এমন অসুস্থতায় ভুগেন, যা রোজা রাখলে তার জন্য কষ্টকর হয় বা স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি করে, তাহলে তিনি সুস্থ হওয়ার পর কাজা রোজা রাখবেন।
- মুসাফির (ভ্রমণকারী) – ভ্রমণের কারণে রোজা রাখা কষ্টকর হলে পরবর্তী সময়ে তা কাযা করে নেওয়া যাবে।
- অক্ষম ও বৃদ্ধ ব্যক্তি – যারা শারীরিকভাবে এতটাই দুর্বল যে, তারা ভবিষ্যতে আর কখনো রোজা রাখতে পারবেন না, তারা প্রতিটি রোজার পরিবর্তে একজন গরিব-মিসকিনকে এক সদকাতুল ফিতরের পরিমাণ ফিদিয়া দেবেন।
রমজান মাসের ফরজে কিফায়া
রমজান মাসে দুটি ফরজে কিফায়া রয়েছে:
১. শাবান মাসের চাঁদের হিসাব রাখা।
২. রমজানের তারিখ ও চাঁদের হিসাব রাখা।
রমজান মাসের সঙ্গে সম্পর্কিত ওয়াজিব আমল
রমজানের সঙ্গে সম্পর্কিত দুটি ওয়াজিব রয়েছে:
১. সদকাতুল ফিতর প্রদান করা – এটি ঈদের আগেই বিতরণ করতে হয়, যাতে দরিদ্ররা ঈদের আনন্দ উপভোগ করতে পারে।
২. ঈদের জামাতে শামিল হওয়া – ঈদুল ফিতরের নামাজ মুসলমানদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত।
রমজান মাসের সুন্নত আমল
রমজান মাসে অনেক সুন্নত আমল রয়েছে, যেগুলো পালন করলে সওয়াব বেড়ে যায়। এসব আমলের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হলো:
রজব ও শাবান মাসে অধিক ইবাদত করা ও রমজানের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করা।রমজান মাসে বেশি পরিমাণে নফল রোজা ও নামাজ আদায় করা।তারাবির নামাজ আদায় করা – এটি রমজান মাসের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সুন্নত ইবাদত। প্রতি রাতে ২০ রাকাত তারাবির নামাজ পড়া এবং তারাবির নামাজে খতমে কোরআন বা পূর্ণ কোরআন শোনার ব্যবস্থা করা সুন্নত।
সাহ্রি খাওয়া ও ইফতার করা – সাহ্রি ও ইফতার করা রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর সুন্নত। দান-খয়রাত বৃদ্ধি করা – রমজান মাসে দান-সদকার ফজিলত অন্য সময়ের চেয়ে বহুগুণ বেশি।
জাকাত প্রদান করা – যাদের উপর জাকাত ফরজ, তারা রমজান মাসে জাকাত দিলে তার সওয়াব আরও বেড়ে যায়।
কোরআন তিলাওয়াত করা – কোরআন নাজিলের মাস হওয়ায় এ মাসে বেশি বেশি কোরআন পড়া ও তা নিয়ে চিন্তাভাবনা করা গুরুত্বপূর্ণ।রমজানের শেষ দশকে ইতিকাফ করা – এটি সুন্নতে মুয়াক্কাদাহ কিফায়া। যারা মসজিদে অবস্থান করে ইবাদতে লিপ্ত হন, তারা বিশেষ সওয়াবের অধিকারী হন।লাইলাতুল কদর সন্ধান করা – রমজানের শেষ দশকের বিজোড় রাতগুলোতে বিশেষভাবে ইবাদত করা এবং শবে কদর পাওয়ার চেষ্টা করা উচিত।
রমজান ইবাদতের মাস এটি আত্মশুদ্ধি ও কলব উন্নতির মাস। এই মাসে মানুষ আল্লাহর কাছে বেশি বেশি তাওবা ও ইস্তিগফার করে। রমজানের প্রতিটি মুহূর্ত মূল্যবান এবং এটি একজন মুসলমানের জীবনকে বদলে দেওয়ার এক অপূর্ব সুযোগ এনে দেয়। রমজান আমাদের জীবনে তাকওয়া অর্জনের শিক্ষা দেয় এবং সারা বছরের জন্য আমাদের ইবাদতের অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে থাকে। আল্লাহ আমাদের সবাইকে রমজান মাসের পূর্ণ ফজিলত ও রহমত , মাগফিরাত ও নাজাত লাভ করার তৌফিক দান করুন। আমিন!
মোহাম্মদ মোহছেন মোবারক
আনোয়ারা প্রতিনিধি