নতুন সব বিশ্ববিদ্যালয় ঘিরে ‘অনিয়ম-দুর্নীতি’, উচ্চশিক্ষার দুরবস্থা তুলে ধরলেন তানজীমউদ্দিন খান

আওয়ামী লীগের গত ১৬ বছরের শাসনামলে বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষা জেনোসাইডের মতো ‘এডুসাইডের’ শিকার হয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) সদস্য ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মোহাম্মদ তানজীমউদ্দিন খান। ১৬ বছরে প্রতিষ্ঠিত ২৬টি বিশ্ববিদ্যালয়ের নানা সংকটের কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, এসব বিশ্ববিদ্যালয়কে বিশ্ববিদ্যালয় বলতে তিনি কষ্ট পান। দেশের বুদ্ধিবৃত্তিক সমাজ, বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষকদের দলীয় সমর্থক বানানোর ক্ষেত্রে এই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে কাজে লাগানো হয়েছে।

‘স্বৈরতন্ত্র থেকে গণতন্ত্রের পথ: বৈষম্যহীন বাংলাদেশের সন্ধানে’ শিরোনামে আজ সোমবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মোজাফফর আহমেদ চৌধুরী মিলনায়তনে দিনব্যাপী সেমিনার আয়োজন করে রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজ বিশ্লেষণমূলক জার্নাল ‘সর্বজনকথা’। দুপুরের পর সেমিনারের দ্বিতীয় পর্বে ‘জেলায় জেলায় বিশ্ববিদ্যালয়: উচ্চশিক্ষার আত্মাহুতি’ শীর্ষক বক্তৃতায় মোহাম্মদ তানজীমউদ্দিন খান এসব কথা বলেন।

ইউজিসির সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালনের অভিজ্ঞতা থেকে অধ্যাপক তানজীমউদ্দিন খান নাম উল্লেখ না করেই কিছু নতুন বিশ্ববিদ্যালয়ের চিত্র তুলে ধরেন। একটি বিশেষায়িত বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে তিনি বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের অবকাঠামো নেই, শিক্ষার্থীর সংখ্যা ছয় শর কাছাকাছি, কর্মকর্তা-কর্মচারী তিন শতাধিক, শিক্ষক ১০৪ জন, ২৪টা বিভাগ। শিক্ষকদের বসারও পর্যাপ্ত জায়গা নেই। আরও কয়েকটি নতুন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভাড়া ঘরে ক্লাস নেওয়া হয়। এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনোটিতেই কোনো গ্রন্থাগার নেই। ২১টি বিশ্ববিদ্যালয় ভাড়াবাড়িতে পরিচালিত হয়। তার মধ্যে কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্মাণকাজ শুরু হয়েছে।

বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অবকাঠামো নির্মাণকাজের প্রকল্প প্রস্তাবগুলো ‘খুবই কৌতূহলোদ্দীপক’ উল্লেখ করে অধ্যাপক তানজীমউদ্দিন খান বলেন, ‘দেখা যাচ্ছে, প্রশাসনিক ও একাডেমিক ভবন আছে; কিন্তু গ্রন্থাগার নেই। অর্থাৎ, গ্রন্থাগার ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়। কিন্তু শিক্ষক নিয়োগ বা বিভাগ খোলার ক্ষেত্রে সবাই এগিয়ে। একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্মাণকাজের বাজেট ছিল প্রায় দুই হাজার কোটি টাকা। তার মধ্যে অপ্রয়োজনীয় একটি প্রমোদতরীর জন্য ২০০ থেকে ৩০০ কোটি টাকা বাজেট রাখা হয়। একটি বিষয় নিশ্চিত হওয়া গেছে, বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার চেয়ে অন্য উদ্দেশ্যগুলো গুরুত্বপূর্ণ হয়ে গেছে। শিক্ষা ও গবেষণার যে ন্যূনতম উপস্থিতি থাকা উচিত, সেটি নেই৷’ শ্রেণিকক্ষ পরিদর্শন করতে গিয়ে সেগুলো দেখে মন খারাপ হচ্ছিল জানিয়ে তিনি বলেন, ‘একধরনের বিষণ্ণতাও আমাকে পেয়ে বসছিল।’

ইউজিসির এই সদস্য জানান, অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০১৪-১৫ সালে শিক্ষা কার্যক্রম শুরু হয়েছে; কিন্তু এখনো তারা ভাড়া ভবনে ক্লাস করছে। এমন বিশ্ববিদ্যালয় আছে, যেগুলো ২০১৭-১৮ সালে চালু হয়েছে, কিন্তু এখন পর্যন্ত কোনো নির্মাণকাজ শুরু হয়নি।

‘গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিল নিয়োগ–বাণিজ্য’

বর্তমানে দেশে মোট ৫৫টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় জানিয়ে অধ্যাপক তানজীমউদ্দিন খান বলেন, আরও ছয়টি বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন হয়েছে; কিন্তু এখনো বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়নি। কিছু বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হওয়ার আগেই উপাচার্য নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। সংগত কারণেই এই উপাচার্যরা আগের মতোই ভাড়াবাড়িতে বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনা করতে চাইছেন। এটা খুব শিক্ষাসম্মত নয়। অবকাঠামো তৈরি ও শিক্ষা কার্যক্রম চালু হওয়ার আগেই যেহেতু উপাচার্য নিয়োগ হয়ে গেছে এবং তাঁদের কেউ কেউ রাজনৈতিকভাবে নিজেকে অনেক বেশি শক্তিশালী প্রমাণ করার চেষ্টা করছেন, তাঁরা শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনার অনুমতি দেওয়ার জন্য একধরনের চাপ তৈরিরও চেষ্টা করছেন। উচ্চশিক্ষা এবং জেলায় জেলায় বিশ্ববিদ্যালয়ের নামে যে ঘটনাগুলো ঘটেছে, সেগুলোর পূর্ণাঙ্গ যাচাই না করে উপাচার্য নিয়োগ দেওয়া একটা নতুন জটিলতা তৈরি করছে।

নতুন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে একাডেমিক কার্যক্রমের চেয়ে নিয়োগবাণিজ্য গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিল বলে অভিযোগ করেন তানজীমউদ্দিন খান। এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে আগে উপাচার্য বা রেজিস্ট্রার পদে থাকা ব্যক্তিরা দুর্নীতির চর্চা তৈরি করেছিলেন বলে উল্লেখ করেন তিনি। অধ্যাপক তানজীমউদ্দিন খান বলেন, ‘কথা প্রসঙ্গে জানতে পারলাম, বেতন স্কেল ১০ হাজার টাকার জন্য ১০ লাখ, ২০ হাজার টাকা স্কেলের জন্য ২০ লাখ টাকা দিতে হতো।’

বিশ্ববিদ্যালয়ে জ্ঞানের চর্চার জায়গায় এগুলো গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিল উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘নিয়োগ ঘিরে বাণিজ্যের পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য জমি অধিগ্রহণ ঘিরে স্থানীয় মাস্তান, চাঁদাবাজ ও দলীয় নেতারা খুবই সংগঠিত হয়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের যোগসাজশে যুক্ত হতো। আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় মনে হয়েছে, এই বিশ্ববিদ্যালয়গুলো প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে ক্ষমতাসীনদের ঘিরে তৈরি হওয়া স্বার্থান্বেষী মহলের স্বার্থ চরিতার্থ করা হয়েছে। শুধু তা-ই নয়, এ রকম আলাপ খুব শক্তিশালীভাবে এসেছে যে প্রকল্প প্রস্তাবের ক্ষেত্রে স্থানীয় ঠিকাদারেরাই মূল ভূমিকাটা পালন করতেন। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সঙ্গে ঠিকাদারের সম্পর্কের মাধ্যমে নির্ধারিত হতো।’

যেসব বিশ্ববিদ্যালয়ের ন্যূনতম নির্মাণকাজ শুরু হয়েছে, সেখানে জমি অধিগ্রহণ ঘিরেও একধরনের রাজনৈতিক অর্থনীতির পরিপূর্ণ বিকাশ লক্ষ করা গেছে বলে জানান অধ্যাপক তানজীমউদ্দিন খান। তিনি বলেন, এসবের ফলে দিনের শেষে উচ্চশিক্ষা আর উচ্চশিক্ষা থাকছে না।

গত ১৬ বছরে প্রতিষ্ঠা করা ২৬টি বিশ্ববিদ্যালয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ন্যূনতম বৈশিষ্ট্য বিরাজ করে না বলে উল্লেখ করেন ইউজিসি সদস্য তানজীমউদ্দিন খান। তবে সেগুলোতে উপাচার্যসহ উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা সুযোগ–সুবিধা ভোগ করেছেন জানিয়ে তিনি বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থা যা-ই হোক না কেন, আমি যখন কোনো উপাচার্যের কার্যালয়ে ঢুকেছি, মনে হয়েছে ‘ওরে বাবা, এ তো বিশাল…’৷ পদাধিকারবলে সরকারি সুবিধাগুলো উপাচার্যদের আকৃষ্ট করে, একটা আকর্ষণ তৈরি করে৷…বুদ্ধিবৃত্তিক সমাজ, বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষকদের দলীয় সমর্থক বানানোর ক্ষেত্রে গত ১৬ বছরের ২৬টা বিশ্ববিদ্যালয় খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। এত সুন্দর বাংলো, এত সুন্দর গাড়ি, এত সুন্দর কার্যালয়—এগুলোর প্রতি যে আকর্ষণ, তা অনেককেই উৎসাহিত করেছে সরকারি দলের সমর্থক হয়ে উঠতে।’

এর মধ্য দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের আসল উদ্দেশ্য জলাঞ্জলি দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে আত্মাহুতির দিকে ঠেলে দেওয়া হয়েছে বলে মন্তব্য করেন তানজীমউদ্দিন খান। তিনি বলেন, দিনের শেষে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মকে একেবারেই শুধু সনদসর্বস্ব শিক্ষিত মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার মধ্য দিয়ে জেনোসাইডের মতো শিক্ষাক্ষেত্রে ‘এডুসাইডের’ সূচনা ঘটানো হয়েছে গত ১৬ বছর। এখান থেকে মুক্তির বিষয়ে আমাদের নতুন করে ভাবা প্রয়োজন।

Share With Your Friends

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *