য়সের ভারে নুয়ে পড়া কর্ণফুলী পেপার মিল (কেপিএম) এলাকায় হচ্ছে নতুন ৬টি কারখানা। ইতোমধ্যে একটি ইন্টিগ্রেটেড পাল্প এন্ড পেপার মিলসহ আরো ৬টি কেমিক্যাল প্ল্যান্ট স্থাপনে সম্ভাব্যতা যাচাইকরণের কাজ সম্পন্ন করেছে পরামর্শক প্রতিষ্ঠান। প্রতিবেদনটি শিল্প মন্ত্রণালয়ে গৃহীত হয়েছে। আগামী বছর এডিপিতে এ প্রস্তাব উত্থাপন হতে পারে বলে আশা করছে কেপিএম কর্তৃপক্ষ। প্রায় ২৫-৩০ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে এ প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে কাগজ শিল্পে কেপিএমের হারানো গৌরব ফিরে আসবে বলে ধারণা করছেন তারা।
মিল কর্তৃপক্ষ সূত্র জানায়, ১৯৫৩ সালে মোট ৫০১ একর জমির উপর তৎকালীন পাকিস্তান শিল্প উন্নয়ন কর্পোরেশন কর্তৃপক্ষ (পিআইডিসি) কারখানা (৬৮ একর) ও আবাসিক এলাকা (৪৩৩ একর) গড়ে তোলে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ড্রাষ্ট্রিজ কর্পোরেশন (বিসিআইসি) প্রতিষ্ঠানটির দায়িত্ব নেয়। প্রতিষ্ঠাকাল থেকে বার্ষিক ৩০ হাজার মেট্রিক টন উৎপাদন ক্ষমতা নিয়ে এর যাত্রা শুরু হয়। সে সময় দেশের সরকারি চাহিদার প্রায় ৭০ ভাগ কাগজ সরবরাহ করতো কেপিএম। কালক্রমে বয়সের ভারে ধীরে ধীরে ৭২ বছরের পুরনো প্রতিষ্ঠানটি জরাজীর্ণ ও রূগ্ন শিল্পে পরিণত হয়ে পড়ে। নানা সমস্যায় জর্জরিত কারখানাটি দুর্দশাগ্রস্ত হয়ে পড়ে। এক সময় শ্রমিক-কর্মচারীদের পদচারনায় মুখরিত থাকা প্রতিষ্ঠানটি বর্তমানে অনেকটা খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছে। নানা প্রতিকূলতা স্বত্তেও মিলটির উৎপাদন আজও চালু রাখা হয়েছে।
কেপিএম সূত্র আরো জানায়, শুরু থেকেই কেপিএমে বাঁশ-পাল্পউডের (নরম কাঠ) মাধ্যমে নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় মন্ড তৈরি করে কাগজ উৎপাদন করা হতো। কিন্তু বিগত ৮ বছর ধরে মন্ড তৈরির পাল্প মিলটি বন্ধ রয়েছে। এরপর থেকে বিদেশ থেকে আমদানি করা পাল্প ও দেশিয় অকেজো কাগজ দিয়ে প্রতিষ্ঠানটির উৎপাদন চালু রাখা হয়েছে। এতে উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি পাওয়ায় মিলটি চালু থাকার পরও নিয়মিত লোকসান গুনতে হচ্ছে। বর্তমানে কেপিএম কর্তৃপক্ষ প্রতি টন উৎপাদিত কাগজ বিক্রি করছে ১ লাখ ৩০ হাজার টাকায়। অন্যদিকে বেসরকারি কাগজ প্রতিটন বিক্রি হচ্ছে ১ লাখ ৬০ হাজার টাকায়। এতে প্রতি টন কাগজে ৩৫ থেকে ৪০ হাজার টাকা লোকসান দিতে হচ্ছে। কারণ কর্তৃপক্ষ চাইলেই কাগজের দাম বৃদ্ধি করতে পারছেনা।
বর্তমানে উৎপাদন ব্যবস্থা টিকিয়ে রাখতে প্রতিষ্ঠানটিকে বছরে প্রায় ২৮-৩০ কোটি টাকা লোকসান গুনতে হচ্ছে। তাই কেপিএমকে বাঁচাতে শিল্প মন্ত্রণালয়সহ বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাষ্ট্রিজ কর্পোরেশন (বিসিআইসি) বিভিন্ন পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ পাওয়া সাপেক্ষে ইন্টিগ্রেডেট পেপার মিলসহ বনায়ন, পেপার ভিত্তিক কেমিক্যাল প্ল্যান্ট, সোডা অ্যাশ, সোডিয়াম সালফেট ও বেসিক কেমিক্যাল প্ল্যান্ট (কাস্টিক সোডা, ক্লোরিন, হাইড্রোজেন পার অক্সাইড, ব্লিচিং আর্থ, টাইটানিয়াম ডাই অক্সাইড, হাইড্রোক্লোরিক অ্যাসিড, সালফিউরিক এসিড, ফসফরিক এসিড ইত্যাদি) এবং সিনথেটিক পলিস্টার ফাইবার প্ল্যান্ট স্থাপন করা হবে। এতে এই কারখানাতে বছরে এক লক্ষ মেট্রিক টন কাগজ উৎপাদন করা সম্ভব হবে। বর্তমানে এই প্রতিষ্ঠান বার্ষিক কাগজ উৎপাদন করছে ৩ থেকে ৪ হাজার মেট্রিক টন।
এদিকে, বর্তমানে মিলের ২৩৭৬ জন স্থায়ী শ্রমিক, কর্মচারী ও কর্মকর্তার বিপরীতে মাত্র ১৮৮ জন স্থায়ী শ্রমিক, কর্মচারী, কর্মকর্তা ও ২৫০ জন অস্থায়ী ঠিকাদার শ্রমিক দ্বারা মিলের কার্যক্রম চলছে।
তবে কেপিএম নানা কারণে আগের মতো উৎপাদনে যেতে পারছেনা। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- মিলে দক্ষ কর্মকর্তা, শ্রমিক- কর্মচারীর অভাব, উৎপাদনের সাথে সম্পর্কিত গ্যাসের শতভাগ দাম বৃদ্ধি, চড়া মূল্যে বিদেশি পাল্প আমদানী করা, অর্থ সংকট, কাগজের মূল্য বৃদ্ধি করতে না পারা অন্যতম।
এ বিষয়ে আলাপকালে কর্ণফুলী পেপার মিলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. শহীদ উল্লাহ বলেন, ৭২ বছরের পুরাতন কারখানাটির অর্থনৈতিক আয়ুষ্কাল বহু আগেই শেষ হয়ে গেছে। কেপিএমকে পুনরায় পুরোদমে সচল রাখতে নতুন করে প্রায় ৩০ থেকে ৩৫ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে সাতটি প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য বিসিআইসি কর্তৃক শিল্প মন্ত্রণালয়ে একটি প্রস্তাবনা পাঠানো হয়েছে। প্রস্তাবনাটি যাচাই-বাছাই চলছে। সরকার যদি প্রকল্পটি অনুমোদন করে তাহলে বছরে এক লক্ষ টন কাগজ উৎপাদন করা সম্ভব হবে। মিলটি পুরোদমে চালু করতে পারলে এই এলাকার আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে যেমন পরিবর্তন আসবে, তেমনি পার্বত্য চট্টগ্রাম ও চট্টগ্রামের ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবে। পাশাপাশি কাগজের বাজারের মূল্য নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে কেপিএম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারবে। কাগজের কাঁচামাল হিসেবে স্থানীয় বাঁশ, পাল্পউডের ব্যবহার বাড়বে এবং এরফলে এই এলাকার অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে ব্যাপক উন্নতি সাধিত হবে।
তিনি বলেন, দেশের সার কারখানাগুলোতে সরকার ভর্তুকি দেওয়ায় প্রতি ঘনফুট গ্যাস তারা ১৬ টাকায় পাচ্ছে, কিন্তু কর্ণফুলী পেপার মিলে প্রতি ঘনফুট গ্যাস ৩০ থেকে সাড়ে ৩১ টাকা হারে কিনতে হচ্ছে। সার কারখানার মতো কেপিএমে গ্যাস ক্রয়ে সরকার ভর্তুকি দিয়ে অর্ধেক দামে ক্রয় করার সুযোগ করে দিলে কেপিএমের কাগজ উৎপাদন ব্যয় বহুলাংশে কমতো। বর্তমানে মিল চালু অবস্থায় প্রতিদিন গড়ে ২৫-৩০ মে. টন উৎপাদন হলে প্রায় ১৩ লাখ টাকার গ্যাসের প্রয়োজন পড়ে। ফলে উৎপাদন করার পরেও মিলকে লোকসান গুনতে হচ্ছে। এছাড়া লোকবল সংকটের কারণে ৩টি পেপার মেশিনের মধ্যে মাত্র ১টি মেশিন দিয়ে কাগজ উৎপাদন করা হচ্ছে। লোকবল সংকট দূর করা হলে ২টি মেশিন পুরোদমে চালানো যেত। এতে লোকাসানও কমে আসতো।
এছাড়া বন্ধ অবস্থায় পড়ে থাকা মিলের কাগজ রূপান্তর প্লান্টটি পুনরায় চালু করার পাশাপাশি বিদেশি পাল্প স্থানীয় বাজার থেকে ক্রয় না করে সরাসরি আমদানি করা গেলে উৎপাদন ব্যয় অনেকাংশে কমে যেত। এসব কার্যক্রম বাস্তবায়িত হলে মিলটি পুনরায় ঘুরে দাঁড়াতে পারবে। কেপিএম ঘুরে দাঁড়ালে দেশের অর্থনীতিও সমৃদ্ধি হবে বলে তিনি মত প্রকাশ করেন।