সংযুক্ত আরব আমিরাতের মালিকানাধীন গবেষণা প্রতিষ্ঠান আল হাবতুর রিসার্চ সেন্টার সম্প্রতি এক প্রতিবেদনে বলেছে, আরব ও মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশগুলো যদি সমন্বিতভাবে ইসরায়েলের জন্য আকাশপথ অবরোধ করে, তবে তা দেশটির অর্থনীতি, রাজনীতি ও নিরাপত্তার ওপর ভয়াবহ প্রভাব ফেলবে। গত ৯ সেপ্টেম্বর কাতারের রাজধানী দোহায় ইসরায়েলের বিমান হামলার পর এমন পদক্ষেপ নেওয়ার আলোচনা জোরালো হয়েছে। ওই হামলায় ফিলিস্তিনের সংগঠন হামাসের নেতাদের লক্ষ্যবস্তু করা হয়, তবে নিহত হন ছয়জন, তাঁদের মধ্যে একজন ছিলেন কাতারের নিরাপত্তা কর্মকর্তা।
ঘটনার পর ইসলামি সহযোগিতা সংস্থা (ওআইসি) ও আরব লীগ জরুরি বৈঠকে বসে। সেখানে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে কী ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া যায়, তা নিয়ে আলোচনা হয়। আল হাবতুরের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আকাশপথ অবরোধের মতো পদক্ষেপ ইসরায়েলের অর্থনীতিকে বড় ধরনের ধাক্কা দেবে। এতে দেশটির মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) ৪ দশমিক ৮ থেকে ৫ দশমিক ৭ শতাংশ পর্যন্ত কমতে পারে এবং দেশটি কার্যত মন্দার মুখে পড়বে।
বিশ্লেষণ অনুযায়ী, যদি তুরস্ক, পাকিস্তান ও ইন্দোনেশিয়ার মতো বড় মুসলিম দেশ এ অবরোধে যোগ দেয়, তবে ইসরায়েল এশিয়া ও আফ্রিকার প্রবৃদ্ধিশীল বাজারগুলোর সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ হারাবে। এতে পূর্ব ও দক্ষিণমুখী ফ্লাইট বন্ধ হয়ে যাবে। অন্যদিকে বিকল্প রুটে যেতে হলে প্রতিটি ফ্লাইটের সময় চার থেকে ছয় ঘণ্টা বাড়বে এবং অতিরিক্ত ৩০ হাজার থেকে ৬০ হাজার ডলার খরচ পড়বে। ইসরায়েলের জাতীয় বিমান সংস্থা এল-আলের আয়ের ৬০ থেকে ৭৫ শতাংশ পর্যন্ত কমে যেতে পারে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
অর্থনৈতিক দিক ছাড়াও পর্যটন খাত ক্ষতিগ্রস্ত হবে। বিশেষ করে হীরা ও চিকিৎসা সরঞ্জামের মতো সময়-সংবেদনশীল পণ্যের রপ্তানি মারাত্মকভাবে ব্যাহত হবে। এতে অনেক আন্তর্জাতিক চুক্তি ভেস্তে যেতে পারে এবং গবেষণা ও উন্নয়ন কার্যক্রম দেশ ছাড়তে পারে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আরব ও মুসলিম দেশগুলোর এই পদক্ষেপ কেবল অর্থনৈতিক ক্ষতি নয়, আঞ্চলিক ভূরাজনীতিতেও বড় পরিবর্তন আনবে।
এমন পরিস্থিতি যুক্তরাষ্ট্রকে কূটনৈতিক সংকটে ফেলবে। দেশটিকে একদিকে ইসরায়েলকে রক্ষা করা আর অন্যদিকে আরব দেশগুলোর সঙ্গে অংশীদারত্ব বজায় রাখার মধ্যে থেকে বেছে নিতে হতে পারে। বিশেষ করে উপসাগরীয় দেশগুলো দীর্ঘদিন ধরে ওয়াশিংটনকে প্রধান কূটনৈতিক ও নিরাপত্তা অংশীদার হিসেবে দেখে আসছে। কিন্তু কাতারের মতো দেশে, যেখানে আট হাজার মার্কিন সেনা রয়েছে, সেখানে ইসরায়েলের হামলা ঠেকাতে যুক্তরাষ্ট্র ব্যর্থ হয়েছে। এ কারণে অনেকেই এখন বলছেন, আরব দেশগুলোকে তাদের নিরাপত্তা ও কূটনৈতিক সম্পর্ক বৈচিত্র্যময় করতে হবে।
ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু বলেছেন, দেশটি এখন বিশ্বমঞ্চে অন্তরিণ হয়ে পড়েছে। তাই অর্থনীতি ও প্রতিরক্ষায় স্বনির্ভর হওয়ার বিকল্প নেই। তিনি ঘোষণা দেন, ইসরায়েল নতুন অস্ত্রশিল্প গড়ে তুলবে এবং হবে একদিকে এথেন্সের মতো জ্ঞান ও গবেষণার কেন্দ্র, অন্যদিকে স্পার্টার মতো শক্তিশালী সামরিক রাষ্ট্র। তাঁর মতে, কয়েক বছরের মধ্যে নিজেদের রক্ষার পাশাপাশি শত্রুকে আঘাত করার ক্ষমতা অর্জন করতেই হবে।
তবে গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাস্তবে আরব ও মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশগুলোর সমন্বিত অবরোধ আরোপের সম্ভাবনা কম। কারণ, এতে যুক্তরাষ্ট্র ক্ষুব্ধ হতে পারে এবং অবরোধকারী দেশগুলোর নিজেদেরও অর্থনৈতিক ক্ষতি হবে। একই সঙ্গে আইনি জটিলতাও তৈরি হতে পারে। শিকাগো কনভেনশনের ৯ নম্বর ধারা অনুযায়ী, সামরিক প্রয়োজনে বা জননিরাপত্তার কারণে আকাশপথ বন্ধ করা গেলেও তা বৈষম্যমূলক হতে পারবে না।
আল হাবতুর রিসার্চ সেন্টারের প্রতিষ্ঠাতা খলাফ আহমদ আল হাবতুর বলেছেন, আরব বিশ্বের হাতে কার্যকর চাপের হাতিয়ার রয়েছে, যা রক্তপাত ছাড়াই ইসরায়েলের ওপর প্রভাব ফেলতে পারে। তিনি নীতিনির্ধারকদের আহ্বান জানিয়েছেন এ প্রতিবেদন গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করার জন্য এবং প্রয়োজনে যৌথ অর্থনৈতিক পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য।
২০২০ সালে যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের মধ্যস্থতায় আব্রাহাম চুক্তির মাধ্যমে আরব আমিরাত, বাহরাইন, মরক্কো ও সুদান ইসরায়েলের সঙ্গে পূর্ণ সম্পর্ক স্থাপন করে। তবে সাম্প্রতিক গাজায় ইসরায়েলের গণহত্যা এবং দোহায় হামলার ঘটনায় এসব দেশ ইসরায়েলের নিন্দা জানিয়েছে। বিশেষ করে আমিরাত এ হামলাকে বলেছে বিশ্বাসঘাতকতাপূর্ণ আগ্রাসন। বিশ্লেষকদের মতে, এটি ভবিষ্যতে তাদের কূটনৈতিক অবস্থান বদলের ইঙ্গিত বহন করছে।
আল হাবতুরের প্রতিবেদনে আকাশপথ অবরোধকে বলা হয়েছে “গ্রে জোন”—শান্তি ও পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধের মাঝামাঝি চাপ সৃষ্টিকারী এক কার্যকর কৌশল। তবে এতে আঞ্চলিক সংঘাতের ঝুঁকি বেড়ে যাবে এবং ইরান ও তার মিত্র গোষ্ঠীগুলো এতে যুক্ত হতে পারে। শেষ পর্যন্ত, অবরোধ বাস্তবায়ন হবে কি না, তা নিয়ে অনিশ্চয়তা থাকলেও আলোচনায় এটি ইতিমধ্যেই একটি কার্যকর রাজনৈতিক ও কৌশলগত অস্ত্র হিসেবে গুরুত্ব পাচ্ছে।