আদানি নিয়ে প্রশ্ন করতেই ‘ব্যক্তিগত বিষয়’ বলে এড়িয়ে গেলেন মোদি

হাজারটা অভিযোগ উঠলেও শিল্পপতি গৌতম আদানির সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক নিয়ে আজ পর্যন্ত মুখ খোলেননি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। যুক্তরাষ্ট্রেও খুললেন না। তবে প্রশ্ন শুনে নিজের বিরক্তিও তিনি চাপা দিতে পারলেন না।

গত ১১ বছরে দেশের মাটিতে একবারও সংবাদ সম্মেলন করেননি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র সফরে সে দেশের প্রেসিডেন্টের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠকের পর প্রথাগতভাবে প্রশ্নের মুখোমুখি হওয়াটা এড়াতে পারেননি।

আগেও অপছন্দের প্রশ্নের মুখোমুখি হয়েছেন, গত বুধবারও হতে হলো। সরাসরি শুনতে হলো আদানি–সংক্রান্ত প্রশ্ন। যদিও কৌশলে উত্তরটি তিনি এড়িয়ে যান এই বলে যে দুই রাষ্ট্রপ্রধান যখন বৈঠক করেন, তখন এই ধরনের ব্যক্তিগত বিষয় নিয়ে আলোচনার অবকাশ থাকে না।

‘ব্যক্তিগত বিষয়’ বলে আদানি প্রসঙ্গ মোদি এড়ালেন বটে, তবে ভারতে তা নিয়ে বয়ে যাচ্ছে সমালোচনার ঝড়।

সংসদে আদানি–মোদি প্রসঙ্গ একাধিকবার তুলেছেন বিরোধী নেতারা। কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধী সরাসরি জানতে চেয়েছিলেন, কেন আদানির বিমান প্রধানমন্ত্রী ব্যবহার করেন? কেন মোদির বিদেশ সফরে সব সময় আদানি সঙ্গী হন? কেন শ্রীলঙ্কা, বাংলাদেশ, অস্ট্রেলিয়া, ইসরায়েল সফরের পরই সে সব দেশে আদানির সংস্থা বিপুল বরাদ্দ পায়? বরাদ্দ পাওয়া নিয়ে প্রভাব খাটানোর অভিযোগ বিদেশে কেন ওঠে?

বস্তুত, রাহুল যেসব প্রশ্ন তুললেন, সেসব গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের কোনো জবাবই সংসদের ভেতরে বা বাইরে মোদি আজ পর্যন্ত দেননি। এমনকি এ–ও দেখা গেছে, সংসদীয় বিতর্ক থেকে আদানির উল্লেখ পর্যন্ত স্পিকারের নির্দেশে মুছে দেওয়া হয়েছে। উপায়ান্তর না দেখে বিরোধীরা শেষ দিকে আদানির নামের আদ্যক্ষর উচ্চারণ করে বুঝিয়ে দিতেন, কাকে তাঁরা বোঝাতে চাইছেন। কোনো কোনো দল মোদি ও আদানিকে ‘মোদানি’ বলেও উল্লেখ করেছেন।

আদানির সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর সম্পর্কই শুধু নয়, শেয়ার বাজারে কারচুপি নিয়ে আদানি সংস্থার বিরুদ্ধে আনা হিন্ডেনবার্গের অভিযোগ নিয়েও সংসদে আলোচনা করতে দেওয়া হয়নি।

ভারতীয় শিল্পপতি গৌতম আদানি

মোদির যুক্তরাষ্ট্র সফরের ঠিক আগে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এক নির্দেশে সে দেশের ‘ফরেন করাপ্ট প্র্যাকটিস অ্যাক্ট’ (এফসিপিএ) কিছুদিনের জন্য স্থগিত রাখতে বলেছেন। আমেরিকায় ব্যবসা–বাণিজ্য করা কোনো সংস্থা বা ব্যক্তি বিদেশে ঘুষ দিয়ে বরাত পেলে এই আইনের আওতায় তা অপরাধ বলে গণ্য হয়। আদানির বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রে যে মামলা হয়েছে, তা এই আইনেই রুজু হয়।

আদানির বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের ন্যায়বিচার দপ্তর ও সে দেশের শেয়ার বাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা আদালতে অভিযোগ করেছেন, ভারতে সরকারি কর্তাদের ২৫ কোটি ডলার ঘুষ দিয়ে তারা সৌর বিদ্যুৎ বিক্রির বরাত পেয়েছে। ঘুষ দেওয়ার সেই তথ্য লুকিয়ে আদানি গোষ্ঠী যুক্তরাষ্ট্রের লগ্নিকারকদের কাছ থেকে বিপুল অর্থ সংগ্রহ করেছিলেন। এই কারণে ফৌজদারি ও দেওয়ানি দুই আইনেই আদানি গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের আদালতে অভিযোগ জমা পড়েছে।

গত বুধবার প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠকের পর হোয়াইট হাউসে প্রথামাফিক সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী মোদিকে এই বিষয়ে প্রশ্ন করা হয়। আদানি যে মোদির ঘনিষ্ঠ শিল্পপতি, সেই মন্তব্য করে প্রশ্নকর্তা জানতে চান—ট্রাম্পের সঙ্গে আলোচনায় আদানি প্রসঙ্গ উঠেছিল কি না।

জবাবে মোদি ভারতের অতিথিপরায়ণতা, তার গণতান্ত্রিক চরিত্র ইত্যাদির উল্লেখ করে বলেন, দুই দেশের রাষ্ট্রনায়কদের বৈঠকে এই সব ‘ব্যক্তিগত বিষয়’ আলোচিত হয় না। প্রশ্নটি যে তাঁর আদৌ পছন্দ হয়নি, মোদির মুখ দেখে তা স্পষ্ট বোঝা গেছে।

কোনোভাবে উত্তর এড়ালেও দেশে সমালোচনার সহ্য করতে হচ্ছে প্রধানমন্ত্রীকে। লোকসভার বিরোধী নেতা রাহুল গান্ধী বলেছেন, ‘আমেরিকায় গিয়ে আদানির দুর্নীতি ধামাচাপা দিয়েছেন মোদি। বন্ধুদের পকেট ভরানোর নীতিই যেখানে রাষ্ট্রনির্মাণ, সেখানে ঘুষের কারবার ও দেশের সম্পত্তি লুট ব্যক্তিগত বিষয়ই তো হবে!’

আম আদমি পার্টি বলেছে, শুধু বন্ধুত্বের প্রমাণই নয়, মোদি স্বীকার করে নিলেন আদানি তাঁর ব্যক্তিগত বিষয়।

তৃণমূল কংগ্রেসের সংসদ সদস্য সাকেত গোখলে বলেছেন, আমেরিকায় সংবাদ সম্মেলনে এমন হাল বলেই মোদি দেশে সংবাদ সম্মোলন করেন না।

কংগ্রেস নেতা জয়রাম রমেশ বলেন, ‘আদানির নাম শুনেই মোদির মুখ ফ্যাকাসে হয়ে গিয়েছিল। অপ্রাসঙ্গিক কথাবার্তা বলে বিষয়টি ব্যক্তিগত বলে এড়াতে চেয়েছেন। দুর্নীতি কবে থেকে ব্যক্তিগত বিষয় হলো জানতে ইচ্ছা করে।’

বিরোধীদের কটাক্ষ, ‘আদানি সম্পর্কিত প্রশ্ন দেশে করলে মোদি মুখে কুলুপ আঁটেন, বিদেশে করলে তা তাঁর ব্যক্তিগত বিষয় হয়ে যায়!’

Share With Your Friends

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *